বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪, ০৫:৩৯ পূর্বাহ্ন

এখন প্রকৃতিই ভরসা!

স্বদেশ ডেস্ক:

রাজধানী ছাড়িয়ে ক্রমেই দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়া ডেঙ্গুজ্বর থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায় এ জ্বরের জীবাণুবাহী এডিস মশা নিধন। কিন্তু ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে যে ওষুধ রয়েছে, তাতে যে এডিস মশাকে কাবু করা সম্ভব নয়, এটি এখন আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

সে ক্ষেত্রে নতুন ওষুধ আমদানি করতে হবে। ওষুধ আমদানি করবে কে- এ নিয়ে সিটি করপোরেশন ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মধ্যে কদিন চলেছে পরস্পরের কাঁধে দায়িত্ব চাপানোর চেষ্টা।

শেষ পর্যন্ত গত বৃহস্পতিবার হাইকোর্টের হস্তক্ষেপে এ ঠেলাঠেলির অবসান ঘটে। হাইকোর্ট জানান, এডিস মশা নিধনের কার্যকর ওষুধ আনবে সিটি করপোরেশন আর এতে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করবে সরকারের সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়, দপ্তর ও সংস্থা। এবার ওষুধ আমদানির পালা।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র সাঈদ খোকন বলেছেন, আগামী সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তার আওতাধীন এলাকার মশা নিয়ন্ত্রণে আসবে। আর উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেছেন, দু-একদিনের মধ্যে মশার ওষুধের নমুনা আসবে। নমুনা পরীক্ষার পর যত দ্রুত সম্ভব তারা ওষুধ আমদানি করবেন।

রাজধানীর দুই নগরপিতার কথাবার্তায় স্পষ্ট, শিগগিরই এডিস মশা নিধনের ওষুধ আসছে না। কারণ বিদেশ থেকে ওষুধ আনার পরও মাঠপর্যায়ে ব্যবহারের আগে অনেক প্রক্রিয়া রয়েছে। ওষুধের কার্যকারিতা পরীক্ষার পর তা মাঠপর্যায়ে ব্যবহারের অনুমতি মিলবে।

আন্তর্জাতিক বিধিবিধান মেনে ওষুধের কার্যকারিতা পরীক্ষা করতে হবে; পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে কিনা, থাকলেও তা কতটা ক্ষতিকর এসব বিষয়েও পরিষ্কার হতে হবে। সব মিলিয়ে সময় লাগবে বেশ কিছুদিন। অথচ ডেঙ্গুর ভয়াবহতা দিনদিন বাড়ছে; রাজধানীসহ দেশজুড়ে বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। উপরন্তু বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, চলতি আগস্টেই ডেঙ্গুজ্বর সবচেয়ে বেশি ছড়িয়ে পড়বে।

এই যখন দশা, তখন ডেঙ্গুজ্বর থেকে রক্ষা পেতে ভরসা করতে হবে প্রকৃতির ওপর। প্রকৃতি যদি সদয় হয়, যদি ভারী বর্ষণ আর ঝড়ো হাওয়া বয়, তা হলে এডিস মশার আবাসস্থল ধুয়ে মুছে যাবে। কিন্তু এর পরও কথা থেকে যায়। ঘরের মশা কিন্তু তখনো থেকে যাবে। তাই প্রকৃতির ওপর ভরসার পাশাপাশি সবাইকে সচেতন হতে হবে। নিজ নিজ উদ্যোগে ঘরের মশা নিধন করতে হবে।

বিশেষজ্ঞরা তাই সব নাগরিককে এ বিষয়ে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। রোগতত্ত্ব ও রোগ নিয়ন্ত্রণ বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে মশা যেন কাউকে কামড়াতে না পারে, সে জন্য প্রত্যেককে সতর্ক থাকতে হবে।

এদিকে ডেঙ্গুর এমন প্রকোপকালে রাজধানীর বিভিন্ন আসনের সংসদ সদস্যদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। তারা বলছেন, সব দায় সিটি করপোরেশনের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। স্থানীয় সংসদ সদস্যদের কি কোনো দায় নেই? তারা কেন মাঠে নামছেন না?

অন্যদিকে ডেঙ্গুজ্বর নিয়ে রাজধানীসহ সারাদেশেই বিরাজ করছে আতঙ্ক। মানুষ জ্বর-সর্দিতে আক্রান্ত হলেই সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় ছুটে যাচ্ছেন। ডেঙ্গু হয়েছে কিনা তা পরীক্ষা করাচ্ছেন। কিন্তু এরই মধ্যে কোনো কোনো এলাকায় ডেঙ্গু পরীক্ষার কিটস ও ডেঙ্গু রোগীদের স্যালাইনের সংকট দেখা দিয়েছে। জেলা হাসপাতালগুলোর ক্ষেত্রে সিভিল সার্জনদের কেউ কেউ নিজ উদ্যোগে স্থানীয় পর্যায় থেকে কিটস কিনে ডেঙ্গু পরীক্ষা করাচ্ছেন।

বরিশাল থেকে নওয়াব আলী নামে একজন অভিযোগ করেছেন, বরিশালের সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গুজ্বর টেস্ট করার কিটস পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি জানান, তার এক স্বজন জ্বরে আক্রান্ত হলে বৃহস্পতিবার রাতে স্থানীয় ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে যান। সেখানে শেরে বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের একজন শিশু বিশেষজ্ঞ দেখান। তিনি রোগীকে ডেঙ্গুর টেস্ট করার পরামর্শ দেন। কিন্তু ডেঙ্গু টেস্ট করার কিটস সরকারি হাসপাতালে নেই বলেও ওই চিকিৎসক আমাদের জানান।

বরিশালে ডেঙ্গু পরীক্ষার কিটস সংকটের বিষয়ে জানতে গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় বরিশাল জেলা সিভিল সার্জনের মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

চাঁদপুর জেলা সিভিল সার্জন ডা. মো. সাখায়াত উল্লাহ বলেছেন, চাঁদপুরের বিভিন্ন হাসপাতালগুলোয় ডেঙ্গুজ্বর টেস্ট করা কিট সংকট রয়েছে। দুদিন আগে ১২০টি কিট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে ৭০টি জেলা সদর হাসপাতালে এবং ৫০টি বিভিন্ন উপজেলায় পাঠানো হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ডেঙ্গু টেস্টের কিটের পাশাপাশি স্যালাইন সংকট রয়েছে।

কিশোরগঞ্জ জেলা সিভিল সার্জন ডা. হাবিবুর রহমান বলেন, আমাদের এখানে প্রতিদিন ২০-২৫ জন ডেঙ্গু ভর্তি হচ্ছেন। ডেঙ্গু রোগ টেস্টের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে কিছু কিট পাঠানো হয়েছে এবং আমরা স্থানীয় পর্যায়ে কিছু কিট কিনে নিয়েছি।

তবে ঢাকার সরকারি হাসপাতালে আপতত কিটের কোনো সংকট নেই। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ব্রায়ান বঙ্কিম হালদার বলেছেন, আমাদের হাসপাতালে ডেঙ্গু পরীক্ষা করার কিটের সংকট বর্তমানে নেই। গত ২ দিন আগে সংকট ছিল। এখন ২ হাজার কিট আমরা বরাদ্দ পেয়েছি।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়–য়া বলেছেন, আমাদের এখানে প্রতিদিন প্রায় ১২০০ জনের ডেঙ্গু টেস্ট করানো হয়। আমাদের ভা-ারের আড়াই হাজারের মতো কিট মজুদ আছে। আমরা রবিবারের মধ্যে কিট কিনে নেব।

রোগ নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন এমন একজন বিশেষজ্ঞ বলেছেন, ২০০০ সালে বাংলাদেশে ডেঙ্গুজ্বরের প্রাদুর্ভাব শুরু হয়েছে। ওই সময় থেকে রাজধানীতে মশা নিধনে যে ওষুধ ব্যবহার করা হচ্ছে, সেটি দিয়ে এডিস মশা নিধন সম্ভব নয়। এটি দ্বারা অ্যানোফেলিস ও কিউলেক্স মশা নিধন করা যায়। তবে এডিস মশা নিধনে যেই ওষুধ ব্যবহার করা হবে সেটি দিয়ে এডিসের সঙ্গে অন্যান্য মশাও মারা যাবে। এখন এডিস মশা মারার ওষুধ আমদানি করতে হবে। ওষুধ আমদানির আগে এর নমুনা সংগ্রহের পর মাঠ পর্যায়ের পরীক্ষা সম্পন্ন করে ওষুধ আমদানি করে ছিটানো পর্যন্ত বেশ কিছুদিন সময় লাগবে। যেহেতু ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি এ কারণে অনেক মানুষ আক্রান্ত হয়ে যাবে। এ অবস্থায় মানুষকে ডেঙ্গুজ্বর থেকে বাঁচতে হলে নিজেকে নিজের প্রটেকশন নিতে হবে।

তিনি বলেন, সিটি করপোরেশন মশা নিধন করলেও বাসাবাড়িতে থাকা মশা নিধন করতে পররবে না। সেগুলোকে যারা বাড়ি তাকেই নিধনের ব্যবস্থা করতে হবে। এ ছাড়া বাসাবাড়ির কোথাও ডাবের খোসা, প্লাস্টিকের কৌটা, বাঁশের খোসা বা অন্য কোনো পাত্রে পানি না জমতে দেওয়া যাবে না। এডিস মশা খাটের নিচে ও টেবিলের নিচেসহ ঘরের আনাচে-কানাচে অবস্থান নেয়। এ জন্য সেখানে ¯েপ্র করতে হবে। ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ রাখতে হবে।

তিনি আরও বলেন, এডিস মশা সাধারণত দিনের বেলায় কামড়ায়। তবে এটি বেশি আক্রমণ করে সূর্যোদয়ের পর ২ ঘণ্টা এবং সূর্যাস্তের ৩ ঘণ্টা আগ পর্যন্ত। এ সময় সম্পর্কে বেশি সতর্ক থাকতে হবে যেন কোনো মশা কামড় দিতে না পারে। এ ছাড়া সকালে বাচ্চাদের স্কুলের মর্নিং শিফট ক্লাস ৭টায় শুরু হয়। মর্নিং শিফটের ক্লাসগুলো ৭টার পরিবর্তে ২ ঘণ্টা পিছিয়ে ৯টায় দেওয়া যেতে পারে। আর ডে-শিফটের ক্লাস ৫টার মধ্যে শেষ করা যেতে পারে।

তিনি আরও বলেন, অনেকে রাতের শপিংমলে যান। রাতের বেলায় অধিক আলোতে এডিস মশা কামড়াতে পারে। আমাদের শপিংমলগুলোয় রাতে আলো থাকে। সেখানে মানুষ ডেঙ্গু মশা দ্বারা বেশি আক্রান্ত হন। শপিংমল যাওয়ার ক্ষেত্রে মানুষকে সতর্ক থাকতে হবে।

তিনি আরও বলেন, এডিস মশা নিধনে ভারী বর্ষণ হলে ভালো হয়। যদি ভারী বর্ষণের সফঙ্গ ঝড়ো হাওয়া বয় তা হলে বাসাবাড়ির বাইরে যেসব এডিস মশা রয়েছে সেগুলো ধ্বংস হয়ে যাবে। বাইরের মশা মারা গেলেও ঘরের মশা রয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে নিজেদের উদ্যোগে ঘরের মশা নিধন করতে হবে।

দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতির হালনাগাদ তথ্য সংগ্রহ করে সরকারি প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন ও কন্ট্রোল রুম। ঢাকা শহরের ১২টি সরকারি এবং ৩৫টি বেসরকারি হাসপাতালসহ মোট ৪৭টি হাসপাতাল থেকে তথ্য সংগ্রহ করে থাকে। এসব হাসপাতালের বাইরে সারা দেশের ৬৪টি জেলা সিভিল সার্জনদের অফিস থেকেও তথ্য সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। গতকাল শুক্রবার (সকাল ৮টা) পর্যন্ত রাজধানীতে ৯৯২ জন এবং রাজধানীর বাইরের বিভিন্ন জেলায় ৬৯১ জনসহ মোট ১৬৮৭ জন আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।

কন্ট্রোল রুমের তথ্যানুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ৬৮৭ জন। চলতি বছরের শুরু থেকে গতকাল পর্যন্ত ২১ হাজার ২৩৫ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হন। এর মধ্যে চিকিৎসা শেষে হাসপাতাল থেকে ১৪ হাজার ৬৩৯ জন বাড়ি ফিরেছেন এবং বাকি ৬ হাজার ৫৮২ জন চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

কন্ট্রোল রুমের তথ্যানুযায়ী, রাজধানীর বাইরে ৮টি বিভাগের ৬৪ জেলায় গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত ৬৯১ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর ঢাকা বিভাগে ১৯০ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ৬২ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ১১৯ জন, খুলনা বিভাগে ৯১ জন, রাজশাহী বিভাগে ৮৭ জন, রংপুর বিভাগে ৩৮ জন, বরিশাল বিভাগে ৭৭ জন এবং সিলেট বিভাগে ১১ জন। রাজধানীর বাইরের জেলাগুলোয় এ পর্যন্ত ৪১৯০ জন আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে ১৯৬৯ জন বাড়ি ফিরেছেন এবং বর্তমানে ২২২১ জন ভর্তি চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

সরকারি হিসাবে এ বছর ডেঙ্গুজ্বরে এ পর্যন্ত ১৪ জন মারা গেছে। হাসপাতালগুলো থেকে যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তাতে মৃতের সংখ্যা এর চারগুণেরও বেশি। বেসরকারিভাবে মৃতের সংখ্যা ৬০ জন ছাড়িয়ে গেছে। গতকালও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে মালিহা মাহফুজ অন্বী নামে ডেঙ্গু আক্রান্ত এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। নোয়াখালীতে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মোশাররফ হোসেন রাজু নামে এক রেলওয়ে কর্মচারীর মৃত্যু হয়েছে। গতকাল শুক্রবার সকালে ফাহিম হাসপাতালে তিনি মারা যান। এসব মৃত্যু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কন্ট্রোল রুমের তথ্যে নেই।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877